১০ বছর আগেই চালু হতো পদ্মা সেতু

Passenger Voice    |    ০১:৪৯ পিএম, ২০২১-০৩-২৪


১০ বছর আগেই চালু হতো পদ্মা সেতু

রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী সৈয়দ আবুল হোসেন পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তার জন্ম ১৯৫১ সালে মাদারীপুরে।

সমকাল: ২০০১ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন; ২০০৯ সালে আপনি যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রস্তুতি শুরু হয়। শুরুর দিককার কথা জানতে চাই।

সৈয়দ আবুল হোসেন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। যেহেতু শেখ হাসিনা মাওয়ায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন, তাই বিএনপি সরকার এসে সেতু অন্যত্র সরিয়ে নিতে তাদের পুরো মেয়াদ শেষ করে। অথচ ২০০৪ সালেই বিশদ সমীক্ষার পর মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শ দেয় জাপান। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পদ্মা সেতু নির্মাণে ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্প অনুমোদিত হয়। আমি যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার তিন দিনের মাথায় ২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত্র মন্ত্রিসভা কমিটিতে সেতুর ডিজাইন পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। পরের বছর এপ্রিলে মূল সেতুর দরপত্র আহ্বান করি। ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়।

সমকাল: দুর্নীতির অভিযোগ না উঠলে এতদিনে সেতু চালু হতো?

আবুল হোসেন: বিশ্বব্যাংক যে মিথ্যা অভিযোগে পরিকল্পিতভাবে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত করেছিল- তা আজ প্রমাণিত সত্য। তখনও প্রকল্পের ঠিকাদার ও পরামর্শক নিয়োগ হয়নি; অর্থ ছাড় হয়নি। সেখানে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র, দুর্নীতির আশঙ্কা ও দুর্নীতি হওয়ার সুযোগ কোথায়? এক বায়বীয় অভিযোগে পদ্মা সেতু ১০ বছর পিছিয়ে গেল। বিশ্বব্যাংকের বাধা না এলে নিশ্চিতভাবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু চালু হতো।

সমকাল: বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ প্রমাণিত মিথ্যা বলছেন। এ ক্ষেত্রে কি কোনো তৃতীয় পক্ষের ষড়যন্ত্র ছিল?

আবুল হোসেন: বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ উত্থাপনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশের কিছু মিডিয়ার খবর। অসত্য ও বেনামি দরখাস্তের ভিত্তিতে প্রচারিত খবর। বিশ্বব্যাংক উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানা অজুহাতে ঠিকাদার ও পরামর্শক নিয়োগ বিলম্বিত করে। নিজেদের পছন্দকৃত অযোগ্য দরদাতাকে নিয়োগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পছন্দকৃত অযোগ্য ঠিকাদারের স্থানীয় এজেন্ট দিয়ে বেনামি দরখাস্ত করে আমাকে জড়িয়ে নানা অপপ্রচার চালায়।

সমকাল: যখন দুর্নীতির অভিযোগ উঠল, তখন মন্ত্রী হিসেবে কাজ করে যাওয়াটা কঠিন ছিল?

আবুল হোসেন: 'এক-এগারো'র সময় আওয়ামী লীগ থেকে আমি পদত্যাগ করেছিলাম। আমার স্বাক্ষর ইম্পোজ করা গায়েবি চিঠি, সড়ক দুর্ঘটনা, সরকারি অফিস মেরামত, গাড়ি ক্রয়, আমার গ্রামের বাড়ি নির্মাণ ইত্যাদি বিষয়ে নেতিবাচক খবর কিছু পত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হয়। এসব বিষয়ে সম্পৃক্ত ছিলাম না। এভাবে নানা দিক থেকে আমার কাজের ওপর প্রেশার সৃষ্টি করা হয়। এতে কিছুটা নিরুৎসাহিত হই। তবে পদ্মা সেতুর ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও অন্যান্য কাজ অব্যাহত রাখি। এই সময়ে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আমাকে অনুরোধ করেন পদ্মা সেতু নির্মাণে ধীরগতি আনতে! এতে থেমে থাকিনি। যখন বিশ্বব্যাংক বুঝল, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে, পত্রিকায় নেগেটিভ খবর ছাপিয়ে কাজের গতিকে রোধ করা যাবে না, তখন বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করে দেয়।

সমকাল: মন্ত্রণালয় বদলের পর নিজে থেকেই পদত্যাগ করেন; নাকি চাপ ছিল?

আবুল হোসেন: আমি জানতাম, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরে গেলে বা পদত্যাগ করলেও বিশ্বব্যাংক এ মেয়াদে ঋণদানে ফিরে আসবে না। বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল। আমাকে আইসিটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসেনি। তারা আমার পদত্যাগ চায়। বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসবে না জেনেও নিজ থেকে পদত্যাগ করি। আমার পদত্যাগ ছিল বিশ্বব্যাংকের নোংরা চেহারা উন্মোচন এবং দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের অবস্থানকে স্পষ্ট করার জন্য।

সমকাল: আপনার রাজনৈতিক জীবনে মিথ্যা অভিযোগ কী প্রভাব ফেলে?

আবুল হোসেন: ক্রমাগত মিথ্যা প্রচারণা মানুষের মধ্যে বিশ্বাস সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। গোয়েবল্‌সের থিওরি তাই বলে। আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। আমার দীর্ঘদিনের অর্জিত সুনাম, খ্যাতি অপপ্রচারের কারণে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছি। পরে অবশ্য আমার ওপর, সরকারের ওপর আরোপিত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আমার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। তবে ইতোমধ্যে মিথ্যা প্রচারণায় আমার যে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, তা কি আর পরিপূর্ণ ফেরত পাওয়া যায়?

সমকাল: পদ্মা সেতু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যে অবদান রাখবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা যৌক্তিক?

আবুল হোসেন: পদ্মা সেতু ছিল যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর আমার 'ফাস্র্দ্ব ট্র্যাক' প্রকল্প। এ সেতুর সঙ্গে আমার আবেগ, ত্যাগ ও পরিশ্রম জড়িত। দেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতু ব্যাপক প্রভাব ফেলবে এবং অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপ্লব আনবে- তা আবেগতাড়িত বক্তব্য নয়; বাস্তবিক। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ দূরত্ব কমবে। সরাসরি যোগাযোগ হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটবে। কাঁচামাল সরবরাহ সহজলভ্য হবে। শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে। বিনিয়োগ বাড়বে। কৃষির উন্নয়ন হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়বে। পর্যটন, কর্মসংস্থান বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ এবং দেশের সার্বিক জিডিপি ১ শতাংশের বেশি হারে বাড়বে।

সমকাল: পদ্মা সেতুর নির্মাণ এলাকা দিয়ে আপনার নিজ জেলায় যেতে হয়। প্রায় সমাপ্ত এই সেতু দেখে কি আপনি সন্তুষ্ট?

আবুল হোসেন: এত বাধার পরও প্রধানমন্ত্রীর প্রবল অভিপ্রায় ও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হচ্ছে। এ জন্য আমি আজ খুব খুশি। খুশি এ জন্য, আমি পদ্মা সেতুর প্রস্তুতি কার্যক্রম দু'বছরে শেষ করে এনেছিলাম। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পথ উন্মুক্ত করেছিলাম। আক্ষেপ হয়, মাঝখানে বিশ্বব্যাংক ও দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে পদ্মা সেতু চালু করতে আমরা ১০টি বছর পিছিয়ে গিয়েছি।

সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।

আবুল হোসেন: সমকালকেও ধন্যবাদ।

সূত্র : সমকাল